নো-ম্যান্স ল্যান্ড (ধারাবাহিক গল্পঃ পর্ব-৬ ও ৭)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ২৫ মার্চ, ২০১৫, ০২:২৫:২৬ দুপুর
৬.
‘সময় যেন কাটে না
বড় একা একা লাগে... ...‘
এই গানটির মত কণার সময়ও কাটতে চায় না। ওরও বড্ড একা একা লাগে। অথচ বাসার সবাই কাছে আছে। কলেজের বান্ধবীদের সাথে প্রায় প্রতিদিনই দেখা হচ্ছে। এরপরও...
নিজের রুমে। বিছানায় বুকের নীচে বালিশ রেখে ওর প্রিয় মানুষটির অনুভূতি অক্ষরে রূপ পেয়েছে যে নীল কাগজটিতে, ওটাকে বার বার ছুঁয়ে দিয়েও ওর কেন যেন মন ভরছে না। বিয়ের পরে রায়হানের পাঠানো তৃতীয় চিঠি । সাথে আর্চির সুন্দর একটি কার্ড। সেটাও নীল রঙের। এই নীলের ভেতরে কি পেয়েছে রায়হান!
নীল বেদনা... কষ্টের প্রতীক... সবই তো নীল।
রায়হান কি ওকে পেয়ে খুশী না তবে?
পাওয়া শব্দটা ভাবনায় আসাতে কেন যেন চমকে ওঠে কণা। সে কি পণ্য? তবে এভাবে ভাবছে কেন?
মহাদেব সাহার "তোমাকে ছাড়া" কবিতা দিয়ে চিঠিটি শুরু করেছে রায়হান...
” তুমি যখন আমার কাছে ছিলে
তখন গাছের কাছে গেলে আমার ভীষণ আনন্দ বোধ হতো
লতাপাতার উৎসাহ দেখে আমি সারাদিন তার কাছে ঘুরে বেড়াতাম
কোন কোন দিন পাখিদের
বাসভূমিতে আমার অনেক উপাখ্যান শোনা হতো
তুমি যখন আমার কাছে ছিলে
তখন প্রত্যহ সূর্যোদয় দেখতে যেতাম তোমাদের বাড়ির পুরনো ছাদে...”
এ পর্যন্ত পড়েই আবার কেন জানি প্রথমে চলে যায় কণা।
আবার পড়ে... আবার শুরু থেকে শুরু করে...
ভালোলাগারা নীল খামের ভেতরের এক নীলকাগজে নীল কাব্য হয়ে ওর হৃদয়কে ঘিরে পাক খেতে থাকে। এ যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি! ওর মনের ইচ্ছেঘুড়ির রং ক্রমশঃ বদলে যেতে থাকে। সাথে অনুভূতিও। আনন্দ-বেদনার এক অপার রহস্যলোকে ঘুরে বেড়ায় মিশ্র অনুভূতি নিয়ে।
গাড়ির হর্ণ ওর ভাবনার পরিসমাপ্তি ঘটায়।
দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায়। সাড়ে পাঁচটা বেজে গেছে। বাবা ফিরেছেন। প্রতিদিন অফিস থেকে এই সময়েই ফিরেন।
উঠে বসে। নিজের রুমে যাবার সময় একবার ওর রুমে উঁকি দিয়েই যাবেন বাবা। নিজের অবিন্যস্ত শরীরকে একটু ভদ্রগোছের করে সামনের ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় তাকিয়ে দেখে।
হ্যা, ঠিক আছে।
নিজের মনকে দেখা যায় এরকম আয়না জাতীয় কিছু যদি থাকত! কতই না ভালো হতো।
কিভাবে ভালো হতো? এই যে এখন ওর মন খারাপ, কিন্তু সে ১০০ ভাগ নিশ্চিত না আসলেই মন খারাপ কিনা। আয়নায় যদি মনের ভালো-মন্দ অবস্থা দেখা যেত, তবে তো ‘আমার মনখারাপ’ এই চিন্তায় চিন্তায় কখনোই মন ভালো হতোনা।
বাবা এলেন। টুকটাক দু’একটি কথা বললেন। সামনে ওর মাস্টার্স পরীক্ষা। ঠিকমত পড়ছে কিনা জানতে চাইলেন। এরপর নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন।
এমনই বাবা! প্রচণ্ড এক জেদী মানুষ। সেই পরিমাণে সহজ। আশেপাশের সবাইকে সব সময় কেমন যেন ‘অ্যাটেনশন’ অবস্থায় রাখতে চান। কিন্তু কারো ওপর একবার মন উঠে গেলেই সব শেষ। আবার যাকে ভালোবাসেন, তাঁর জন্য মন-প্রাণ এক করে দেন। কিন্তু অন্যরা বাবাকে সহজে বুঝে উঠতে পারে না। চকিতে মনে প্রশ্ন জাগে কণার, ’মা কি বাবাকে বুঝতে পারেন?’
হয়তো পারেন... হয়তো না। কিন্তু ওর সামনে এলে মা-বাবার দুজনের ভেতরে কেমন যেন এক অদৃশ্য মুখোশময় আচরণ অনুভব করে কণা।
রায়হানের সাথে বাবার কোথায় যেন মিল রয়েছে। কিন্তু কণা ঠিক বুঝতে পারেনা, ঠিক কোথায়? এজন্যই কি রায়হানকে বেশী ভালো লাগে? ছেলেবেলা থেকে শুরু করে কিছু দিন আগ পর্যন্ত বাবাকে ঘিরে আনন্দময় সেই সময়গুলোর ভেতরে ‘বাবাময়’ যে জীবনকে কাটিয়ে এসেছে, রায়হান নামের একজনের সাথে কাগজে কয়েকটি স্বাক্ষরের দ্বারা এক নতুন জীবনের দ্বারপ্রান্তে এসে কণা কি দ্বিধাগ্রস্ত? নতুন জীবন কি ওর সামনে ‘রায়হানময়’ হয়ে দেখা দিবে?
মানুষের জীবনে এতোগুলো ধাপ কেন? বিশেষ করে মেয়েমানুষের?
ওর হৃদয়ে কেন রায়হানের জন্য বাবার মতো মমতার উদ্রেক হয়, সেই উত্তরটি আজো জানা হলো না। ক’দিন ধরেই এই বিষয়টি নিয়ে ভাবছে কণা। মায়ের ডাকে আজো জানা হলোনা। বাবার জন্য বিকেলের নাস্তা বানাতে মাকে সাহায্য করতে হবে। এভাবেই করে এসেছে পেছনের দিনগুলোতে। এরপর কি হবে? বাবা বড্ড একা হয়ে যাবেন। হঠাৎ করে মনটা আরো খারাপ হয়ে গেলো। মন খারাপের আজ বোধহয় বিশেষ কোনো পার্বণ চলছে। থেকে থেকে কেবলি খারাপই হয়ে চলেছে।
নাস্তা বানানো শেষ হলে ডাইনিং টেবিলে বাবার সাথে কণা। কলেজে ব্যবহারিক ক্লাশ না থাকলে প্রায় বিকেলেই মা-বাবা আর সে বেশ আনন্দঘন মুহুর্ত কাটায়। কণার একমাত্র ছোট ভাই বাদল তখন বাসায় থাকে না। কলোনির অন্য ছেলেদের সাথে ওর নিজের আলাদা জগতের অধীশ্বর সে তখন।
টেবিলে বসে খেতে খেতে বাবা কণাকে জিজ্ঞেস করেন,
‘ রায়হানের সাথে কথা বার্তা হয়?’ উত্তরে কনা না বলে।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বাবা আবার বলেন,
‘তোর পরীক্ষার আর ছয়মাস বাকী আছে। এর ভিতরে কোনো দেখা সাক্ষাৎ করবি না। রায়হান চাইলেও না। বুঝেছিস?’
এবারও কনা ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানালে বাবা মনে হয় একটু বিরক্ত হলেন। বললেন,
‘কিরে, কথা বলছিস না কেন?’
‘ হ্যা, বুঝেছি।
কণার জবাবের স্বরটি কি একটু উদ্ধত শোনালো? নাহলে এক সাথে বাবা-মা দুজনেই ওর দিকে তাকালেন কেন?
বাবা নীরবে নাস্তা করে যান। কিন্তু মা অনেকক্ষণ কণার দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিছু একটা ভাবেন। কণা অপ্রতিভ এবং বিমর্ষ হয়ে পড়ে। তবে নিজের অনুভূতিকে সে তাঁর জন্মদাত্রীর নিকট থেকে লুকোবার ব্যর্থ চেষ্টাকরে। কিন্তু সম্ভব হয় কি?
নিজের রুমে এসে কণা কেন জানি অস্থির হয়ে পড়ে। বাবার কথাগুলো বার বার কানে বাজতে থাকে। ‘...এর ভিতরে কোনো দেখা সাক্ষাৎ করবি না... রায়হান চাইলেও না...’।
কিন্তু রায়হান চাইলে তবেই না?
আজ দীর্ঘ একটি মাস হয়ে গেলো ওদের আকদ হয়েছে। এর ভেতরে একবার রায়হান শহরের বাসায় এসেছে। কণা খোঁজ নিয়েছে। বাকী সময়টা সে দূরের কোন গাঁয় পড়ে থেকেছে...একেলা... রায়হানের মোবাইল আছে। সে কি বাসার টি এণ্ড টি নাম্বারে ফোন করতে পারতোনা? কেন ফোন করলো না? কি চলছে ওর মনে?
অথচ শেষবার নিউমার্কেটের আইসক্রীম কর্ণারটিতে যে রায়হানকে সে পেয়েছিল, দূরের নিভৃত গাঁয়ের মানুষটিও কি সে নয়?
কি হয় একবার ফোন করলে?
সরকারী কলোনীর এক ফ্ল্যাটে বৃত্তাবদ্ধ জীবনে এক নববিবাহিতা যুবতী নিজের রুমে বসে ভাবনার ভ্রান্তিবিলাসে সময় কাটাতে থাকে। হৃদয় উপচানো ভালোবাসা নিয়ে প্রিয় মানুষটির থেকে দূরে থাকাতে ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! এই কষ্টের তীব্রতাকে কে অনুভব করতে পারে? ওর মত এরকম পরিস্থিতিতে ক’জন পড়েছে?
একসময় বাবার ওপর রাগ হতে থাকে।
সামনে পরীক্ষা। বেশ তো চলছিল ওর জীবন। বাবা-মা আর ছোট ভাইকে সাথে নিয়ে ওর নিজের ভূবনটিতে সে এক রাজকন্যার মতই ছিল। হঠাৎ কি যে হল!
যাকে জীবনে দেখেনি, সেরকম একজনকে বাবা পছন্দ করলেন। বাসায় এসে নিজের সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করলেন। ঐ ছেলেকেই বিয়ে করতে হবে। বাবা কথা দিয়েছেন।
সেদিনও বাবার ওপর প্রচণ্ড রাগ হয়েছিল।কিন্তু আজ যেমন রাগকে প্রকাশ করতে পারছে না, কণা সেদিনও পারে নাই। ভালোবাসার মানুষের ওপর রাগ হলে কষ্ট লাগে ঠিকই। কিন্তু সেই কষ্টটাকেও যেমন দেখানো যায় না,রাগের বহিঃপ্রকাশও করা যায় না।। এরপর যখন রায়হানকে দেখলো, প্রথম দেখাতেই কণার পছন্দ হয়ে গেলো! মনে হচ্ছিল, এই ছেলেকে না পেলে কণা মরে যাবে! আজ ভাবলেও হাসি পায়। কি সস্তা সেন্টিমেন্ট! কিন্তু সেদিন এই অনুরাগই ওর হৃদয়ের গভীরে জমাট বেঁধেছিল। যেখান থেকে ভালোলাগা ধার নিয়ে এসে অনেক রাত সে কাটিয়েছিল... রায়হানকে ভেবে ভেবে। ওদের আকদের আগের ক’টা দিনের কথা ভাবলেও আজ কেমন যেন লাগে।
আর যখন অচেনা অজানা ছেলেটিকে ভালো লাগলো... ওর প্রতি ভালোবাসায় লীন হতে যাবে, এমন সময়েই বিধি নিষেধের খড়গ এসে কণার অনুভূতির মগজে করাত চালানোর তীব্রতর অনুভবে বিলীন করে দিয়ে গেলো!
দেখাই যদি করতে পারবে না কিংবা একটু কাছে যেতে পারবে না- তবে কি দরকার ছিল এভাবে বিয়ে দেবার? একেবারে পরীক্ষা শেষ হলেই...
মা দরোজা দিয়ে ঢুকতেই ভাবনা-চন্তা আবারো শিকেয় তুলে রাখে কণা।
মা কাছে আসেন।
কণার দিকে তাকিয়ে হাসেন। কণাও হাসে।
মায়ের হাতে একটা প্যাকেট। সেটা খুলতেই একটা মোবাইল সেট বের হয়। জিজ্ঞাসু নেত্রে কণা মায়ের দিকে তাকায়। মা বলেন,
‘ তোর জন্য আজ কিনেছি। রায়হানের নাম্বার কি তোর কাছে আছে?’
লজ্জায় কেন জানি লাল হতে হতে একেবারে ক্রিসমাস রেড রূপ ধারণ করে কণা। মায়ের দিকে তাকাতে পারে না। মাথা নিচু করে নিজের পায়ের নখ দেখতে থাকে। তবে মিসেস তাহমিনা ফারুক মেয়ের মুখ না দেখতে পেলেও সে যে এইমুহুর্তে এক জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি... ওর সারা শরীর থেকে কি এক আনন্দ ছিটকে বের হতে থাকে... একজন মা হিসেবে তিনি অনুভব করেন। নতমুখে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ের গালে আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে নিজের ভালোবাসা জানান।
মা বের হয়ে গেলেই কণা মোবাইল সেটটি হাতে নেয়। প্রিয় মানুষটির চেহারার মত তাঁর মোবাইল নাম্বারটিও ওর হৃদয়ে গেঁথে আছে। কাঁপা কাঁপা হাতে নাম্বার টিপতে থাকে। সবগুলো ডিজিট এক জায়গায় হলে সবুজ বাটনটি প্রেস করে।
এবার দুরু দুরু বুকে অপেক্ষা!
শহরের ফ্ল্যাটের নির্জন রুমে হৃদয় উপচানো কষ্টকর কিছু ভালোবাসা নিয়ে এক যুবতী তাঁর প্রিয় মানুষটিকে স্মরণ করে...তারহীন এক মাধ্যমের ভেতর দিয়ে ওর ইচ্ছেগুলো ডানা মেলতে উন্মুখ হয়ে থাকে... রিঙ বেজে চলে... সময় বয়ে যায়...
কিন্তু অপেক্ষা কি শেষ হয়?
(ক্রমশঃ)
৭.
কণা যাকে ফোন করে চলেছে, সে তখন রিক্সায় দুই সহকারীর সাথে গ্রামের পথে। ওর মোবাইল রয়েছে স্কুলে নিজের থাকার রুমের ড্রয়ারে। সাথে রেখেই বা কি করবে। এমন জায়গায় থাকে,নেট খুবই দুর্বল। আসা-যাওয়ার ভিতরে থাকে। গ্রামীন ফোন সবে তাদের যাত্রা শুরু করেছে। আর রয়েছে অ্যাকটেল। রায়হান প্রতিদিন মায়ের সাথে কথা বলে যেখানে যেখানে নেট পাওয়া যায়, সেই জায়গাগুলোতে গিয়ে। একটা মোবাইল অ্যান্টেনা কিনবে বলে সেই কবে থেকে ভাবছে। কিন্তু আলসেমী করে আর কেনা হচ্ছে না।
কলেজ বিল্ডিঙয়ের ছাদের পুর্ব পাশে, দীঘির উত্তর পাশের পাড়ে আর সেই বিসিক বিল্ডিঙ্গটির ছাদে সব সময় নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। তাই গ্রামের পথে বের হবার সময় রায়হান সাধারণত মোবাইল সাথে নেয় না।
এইপ্ রতিষ্ঠানে জয়েন করেই একটি এস.এস.সি ব্যাচ পেয়েছে। তারা টেস্ট পরীক্ষা দিয়েছে কেবল। ফর্ম ফিল আপ করার সময়েই রায়হান প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে যোগ দিলো। কতটা ঝক্কি পোহাতে হয়েছিল ঐ দিনগুলোতে! আজো মনে পড়লে কেমন যেন লাগে রায়হানের কাছে। ওর সাথের রাসেল সাহেব এবং জমির সাহেব কে একপলক দেখে। ওনারা বুঝতে পারেন যে রায়হান তাদেরকে দেখছে। কিন্তু তাঁরা নির্লিপ্ত থাকেন।
দু’পাশে সবুজ ধানক্ষেত। অন্য সব গ্রামের মতো একই দৃশ্য। দেখে চোখ এবং মন জুড়িয়ে যায়। দেখার সাথে অনুভবের এক অদৃশ্য যোগাযোগ রয়েছে। মাটির রাস্তায় ধূলা উড়িয়ে এক শিশু লোহার গোল একটি চাকতি অন্য একটি লোহার রড দিয়ে ঠেলে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে। ওর মনোযোগ ঐ চাকতিটির ঘুর্ণনের দিকে নিবিষ্ট। কি এক অপার আনন্দে সে উদ্ভাসিত হয়ে আছে। রায়হানের মনটা কেন জানি ভালো হয়ে যায়।
ফর্ম ফিল আপের সময় বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সিদ্ধান্ত হয়েছিল যারা শুধু মাত্র এক বিষয়ে ফেল করেছে, তাদেরকেই পরীক্ষায় অংশগ্রহনের সুযোগ দেয়া হবে। এ ব্যাপারে অধ্যক্ষ যেন এই সিদ্ধান্তের ওপর অটল থাকেন। আর সবাইকেই বাধ্যতামূলক কোচিং করতে হবে। একটা নির্দিষ্ট অংক সর্বসম্মতিক্রমে স্থির করা হলো কোচিং ফিস হিসাবে। এরপরই শুরু হলো একের পর এক ঝামেলা।
অনেকেই কোচিং করতে চাইলো না। আবার যারা কোচিং ফিস দিতে চাইলো, তাদের ভেতরে কিছু এলোঅ ভিভাবক সদস্যদের স্বাক্ষর করা অনুমতিপত্র নিয়ে। কোচিং ফিস হ্রাস করার জন্য। চারজন অভিভাবক সদস্য যেন এই ফিস কমানোর স্লিপে স্বাক্ষরের প্রতিযোগিতায় নেমেছিলেন! এরপরে ছিল গরীব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা । এদের ফিস অধ্যক্ষ নিজ ক্ষমতাবলে কমালেন। তবে এরপরও কোচিং ফিস থেকে যে পরিমান টাকা উঠেছিল, সকল শিক্ষকদের ভেতর চলে আসা নিয়মানুযায়ী বন্টনের পরে দেখা গেলো সবাই বেশ ভালো অংকের টাকা পেয়েছেন। বছরে শিক্ষদের বাড়তি আয় বলতে তো এইটুকুনই।
তবে বিব্রতকর বিষয়টি ছিল প্রধানশিক্ষক/অধ্যক্ষ হিসেবে রায়হান সব থেকে বেশী অংকের টাকা পেলো। যদিও সে নিজে কোচিং এ ক্লাশ নিচ্ছে। কিন্তু তারপরও টাকাটা নেবার সময়ে কেমন লজ্জা-সংকোচ ওকে ঘিরে ধরেছিল।
এই কথা ওর কাছের মানুষ রাসেল সাহেবকে জানিয়েছিল ও সে। কিন্তু তিনি বলেছিলেন,
‘স্যার,এটাই চলে আসছে। আপনি তো নিজের থেকে ক্লাশ নিচ্ছেন। আগের প্রধানেরা কোনো ক্লাশ না নিয়েও বড় অংকটা নিজেরাই নিতেন। আর এবার কতজনের কোচিং ফির টাকা আপনি নিজেই তো দিলেন।‘
কথা সত্য। যখন চারদিক থেকে ফিস কমানোর এক হুজুগ উঠে গেলো, তখন ওদের দেখাদেখি কয়েকজন বেঁকে বসলো, তাঁরা কি দোষ করেছে? কেন তাদের কোচিং ফিস কমানো হবে না? আজীবন শহরের পরিবেশে মানুষ হওয়া রায়হান অবস্থার প্রেক্ষিতে ভীষণ অসহায় বোধ করলো। কি করা যায় ভাবছিল। শেষে মাকে ফোন করে কিছু টাকা চাইলো। জুনিয়র ক্লার্ক শাহেদকে পাঠালো শহরের বাসায়। সে গিয়ে টাকা নিয়ে এলো। ঐ টাকা দিয়ে যারা একটু বেশী সমস্যা করলো, তাদের দেয়া টাকার সাথে প্রয়োজনীয় বাকী টাকা দিয়ে রায়হান সব সামলে নিলো। মা জানতেও চাইলেন না টাকার প্রয়োজন কেন? এভাবেই ছিলেন মা।
ছিলেন মানে?
এখন কি নেই?
আবার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। সেই সাথে ভাবনাগুলোও চলে যায়।
সামনে একটা কালভার্ট। নামতে হবে এবার। তিনজনকে নিয়ে এমনিতেই রিক্সাওয়ালার কষ্ট হচ্ছে। ঐ ঢাল বেয়ে ওঠা সম্ভবপর নয়। সবাই নেমে এলো। এই রিক্সাটি প্রতিষ্ঠানের জন্য কেনা হয়েছে। বিভিন্ন কাজে প্রায় সময়েই ক্লার্ক এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানকে অনেক জায়গায় যেতে হয়। সেই সব খাতে যে পরিমান বিল করা হয়, তা মোটামুটি চোখে লাগার মত। রায়হান পরিচালনা পরিষদের সভায় বিষয়টি তোলে। এরপরই একটা রিক্সা কেনা হয়। গ্রামের রাস্তায় এই বাহনটি ই সবচেয়ে উপযোগী।
ইতোমধ্যে সুর্য ডুবে গেছে।
এই সাঁঝের বেলায় রায়হান বাড়ি বাড়ি এস.এস.সি পরীক্ষার্থীদের হালচাল দেখতে যাচ্ছে। সাথে সিনিয়র শিক্ষক রাসেল সাহেবকে নেয়া হয়েছে শুধুমাত্র পেটানোর জন্য। ওনার হাতে জোড়া বেত রয়েছে। ছাত্র-ছাত্রীরা যমের মত ভয় পায়ও নাকে। সেই পরিমাণে ভালোও বাসে। শিক্ষক হিসেবে ‘ক্লাশ ওয়ান’ রাসেল সাহেব। আর প্রভাষক জমির সাহেব পুরনো বন্ধু মানুষ। তিনিও ইদানিং স্কুল কম্পাউন্ডে থাকা শুরু করেছেন। ওনার জন্য একটা রুম যা অতিরিক্ত পড়েছিল, পরিষ্কার করে দিয়েছে চৌধুরী। রাসেল সাহেব উপজেলার বাসা থেকে প্রতিদিন যাতায়াত করতেন। এখন পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনিও রাতে জমির সাহেবের সাথে এখানেই থাকছেন। কারণ প্রতিদিন পরীক্ষার্থীদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে আসতে বেশ রাত হয়ে যায়। এজন্যই রায়হান বলেছে স্কুলেই থেকে যেতে। রফিককে তিনজনের বাজার করার টাকা দিয়ে দেয়। রাতে তিনজন তৃপ্তি করে খাবার খায়। সময়গুলো বিশাল এই ক্যাম্পাসে আঁধারের ভেতর হ্যারিকেনের আলোয় খারাপ কাটছে না।
প্রথম যে বাড়িটিতে রায়হান ঢুকলো, সেখানে নির্দিষ্ট ছাত্রটিকে পড়ার টেবিলেই পেলো। ওদেরকে দেখে ছাত্রটির বাবা-মা আপ্যায়ণের জন্য অস্থির হয়ে পড়ল। রায়হান গম্ভীর হয়ে না করলো। পরীক্ষা শেষে একদিন এসে ভালোভাবে পেট পুরে খেয়ে যাবে কথা দিয়ে তাদেরকে নিবৃত করালেন রাসেল সাহেব। জমির সাহেব ছাত্রটির সাথে মিনিট পাঁচেক কথা বললেন। দুর্বোধ্য কিছু একটা বুঝিয়ে দিলেন।
পরের বাড়িটিতে গিয়ে রাসেল সাহেবকে কাজে লাগাতে হলো। এই সন্ধ্যা বেলায়ই পরীক্ষার্থী ছাত্রটি নিজের বাবার পাশেই ঘুমিয়ে আছে। দেখে খুব অবাক হল রায়হান। একজন অভিভাবক নিজে তাঁর ছেলেকে পাশে নিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। অথচ এই ছেলেটিকে রায়হান ফর্ম ফিল আপ করার সুযোগই দিতে চায়নি। সে তিন বিষয়ে ফেল করেছিল টেস্টে। ওর বাবা অনেক অনুরোধ করে, দুজন অভিভাবক সদস্যকে সাথে নিয়ে এসেছিল রাতের বেলা। অবশেষে বন্ড স্বাক্ষর করার পরে ছেলেটিকে অনুমতি দেয় রায়হান। বন্ডে লিখা ছিল এই ক’মাস খুব ভালোভাবে পড়ালিখা করবে এবং প্রতিষ্ঠান প্রধানের কথামতো চলবে এই ক’দিন। এটা একটা ফর্মালিটি। নচেৎ এই সব বন্ড দিয়ে কি আর পড়ালিখা হয়? কিন্তু পরিচালনা পরিষদের ঐ দুই অভিভাবক সদস্যের স্বাক্ষরও নিয়ে ছিল। এরাই যেহেতু সুপারিশ নিয়ে এসেছে, আবার পরীক্ষার ফলাফল খারাপহলে তখন এই এরাই রায়হানের বিরুদ্ধে জোর গলায় আওয়াজ তুলবে। এটাই গ্রাম্য রাজনীতি। যার বিন্দুমাত্র জানা ছিল না রায়হানের। তাই যখন পরিচালনা পরিষদ এক বিষয় পর্যন্ত অকৃতকার্যদেরকে ফর্ম ফিল আপের সুযোগ দেবার সিদ্ধান্ত নেয়, রাসেল সাহেব গোপনে রায়হানকে পরবর্তী ধাক্কা সামলাতে এই সুপরামর্শ দিয়েছিল।
রাসেল সাহেব ঘুমন্ত ছেলেটিকে উঠিয়ে কয়েকটি বেতের বাড়ি মারলেন। রায়হানের ইচ্ছে হচ্ছিলো, আগে ছেলেটির বাবাকে কিছুক্ষণ পিটাতে। তাঁর নিজের কোনো গরজই নেই। অথচ ছেলেকে ফর্ম ফিল আপের সুযোগ দেবার জন্য সে কত কান্ডই না করলো। এখন যখন আসল সময় এসে গেলো কিছু করার, তখনই সে নিজের দায়িত্ব ভুলে গেলো। সুস্থ ছেলেকে পাশে নিয়ে কেমন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে। অথচ এই ছেলেটি পরীক্ষায় খারাপ করলে এর দায়ভার সব এসে পড়বে রায়হানের উপর। পরিচালনা পরিষদের চাপ থাকবে কেন তাদের কথার বাইরে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে সুযোগ দেয়া হলো? আর অভিভাবকেরা টাকা নিয়ে ঠিকমতো কোচিং করানো হয়নি ইত্যকার কথাবার্তা দ্বারা পরিবেশকে গরম করে তুলবে।
ছেলেটি মুখ হাত ধুয়ে পড়ার টেবিলে বসেছে। রাসেল সাহেব ওকে গণিত বিষয়ে কিছু একটা দেখিয়ে দিচ্ছেন। এই বিষয়েও ছেলেটি খারাপ করেছিল টেস্টে। অন্ধকারে উঠানে দাঁড়িয়ে রায়হান আকাশের তারাগুলো দেখছিল। আর আনমনে ভাবছিল। একজন অভিভাবক তো সরাসরি রায়হানকে থ্রেট করেছিলেন। তিনি বর্ডারে চোরাকারবারের সাথে জড়িত। একই সাথে ক্ষমতাসীন দলের নষ্ট রাজনীতির নিম্নস্তরের একজন । তাঁর ছেলেও তিন বিষয়ে ফেল করেছিল টেস্টে। তাই রায়হান যখন কোনোমতেই সুযোগ দিতে রাজী হচ্ছিল না, এই লোক রায়হানকে বলেছিল, ‘ একদম ব্রাশফায়ার করে দেবো।‘ উত্তরে রায়হান ব্যথিত হয়ে লোকটির দিকে তাকিয়েছিল। সেদিন অন্য শিক্ষকেরা তাঁকে রায়হানের রুম থেকে বের করে নিয়ে শিক্ষকদের রুমে নিয়ে যায়। তবে অশিক্ষিত এরকম একজনন অভিভাবকের কথায় ব্যথা পেলেও রায়হান ওনার ছেলেকে শেষ পর্যন্তসু যোগ দিয়েছিল। অন্যদেরকে যে সুযোগ দিয়েছে, এই ছেলেটিকেও সেটা দিয়েছে।
একজন আলোকিত মানুষ হতে হবে।
রাতের আঁধারে তাই গ্রামের পথে পথে হেঁটে বেড়ায় রায়হান। নিজে আলোকিত মানুষ হবার চেয়ে কিছু আলোকিত মানুষ তৈরী করাই কি অনেক ভালো নয়? ইদানিং এই ভাবনাটিতেই ওকে পেয়ে বসেছে।
ভাবছে সে... নিরন্তর ভেবেই চলেছে।
রাতের খাবার খেয়ে রাসেল সাহেব ও জমির সাহেব নিজেদের রুমে চলে গেলেন। চৌধুরীকে সাথে নিয়ে রায়হান দীঘির জলে ‘বোট ভ্রমনের’ জন্য বের হয়। এবার সাথে মোবাইল ফোনটি রয়েছে।
রাতের বাতাসে মনটা জুড়িয়ে যায়। রায়হানের ও তেমন অনুভূতি হলো।
মোবাইলের ডিসপ্লেতে একটা অচেনা নাম্বার থেকে বেশ কয়েকবার ফোন এসেছিল। এখন মিসডকল দেখাচ্ছে।
কার হতে পারে?
এই নাম্বার খুব অল্প ক’জনই জানে। যারা যারা জানে তাদের সবার নাম্বারই সেভ করা আছে। তবে কি ভুলে চলে এলো? কিন্তু ভুলে হলে একবার বা দু’বার কল আসতো। এগারো বার কল আসতো না।
কি করবে? ফোন করে দেখবে নাকি?
দু’বার ফোন করতে হলো ওপাশের অচেনা মানুষটি কে তা জানতে।
কিন্তু যার গলা শুনলো, সেটা সম্পুর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল রায়হানের জন্য।
যে মেয়েটিকে নিয়ে দিনরাত্রি ভেবে ভেবে সময়গুলো কেটে যায় শামুকের গতিতে... সেই মেয়েটির মিষ্টি গলা ভরা দীঘির মাঝে রূপালী চাঁদের আলোর বন্যায় ভেসে যেতে যেতে রায়হানের হৃদয়কে এক অপার্থিব অনুভূতিতে প্রগলভ করে তোলে!
সে শুধু বলে, ’তুমি!’
‘হ্যা,আমি! কেন তুমি কি আর কাউকে আশা করেছিলে নাকি?’ ওপাশ থেকে কণা উত্তর দেয়।
অন্য সময় হলে রায়হান রাগ হতো। কিন্তু আজ কেন জানি রাগ হতে পারে না। প্রকৃতি আজ নতুনভাবে সেজেছে মনে হলো ওর কাছে। সে কি এমনিতেই? ওদের দুজনকে এভাবে কাছে এনে দিতেই কি নয়? কেন দূরে থাকা তবে? মনের আড়ালটুকু কিসের জন্য রেখে দেয়া?
রফিককে দীঘির একটি নির্দিষ্ট দিকে বোট নিয়ে যেতে বলে ইশারায়। ওখানেই গ্রামীনের নেট সব থেকে বেশী। দেখেছে সে এ ক’দিন। পাড়ে বোট ভিড়লেই রায়হান বোট থেকে নেমে উপরে ওঠে। এই পাড়ে কবর নেই। ঢিবির মত উঁচু মাটির পাড় চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত। রায়হানের মনের মতই কি?
কথার মায়াজালে ধীরে ধীরে রায়হান জড়িয়ে যায়। সময় বয়ে যায়। আশেপাশের সব কিছু বিস্মৃত হয় রায়হান। ভুলে যায় সে কোথায়। ভুলে যায় আম্মার সাথে ওর কথা বলার কথা। প্রতিদিন এই নিয়ম মেনে চলেছে। আজ কণার সাথে কথা বলতে বলতে কি এক নেশায় পেয়ে বসে রায়হানকে।
কথার নেশায়... অনুভূতি শেয়ার করার নেশায়... ভালোবাসার মানুষকে একটু হলেও অনুভব করার নেশায়... হৃদয়ে জমে থাকা অনেক অনেক কথা বলার নেশায়!
অনেক কিছু বলতে চায় আজ রায়হান।
কিন্তু পারে কি?
কি কথা এতো তাহার সনে?
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
১০১৩ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বারাকাল্লাহু ফীহ।
আমি আপনার শুভাকাংখী হিসেবে একটি পরামর্শ দিতে চাই.... ব্লগে বলা ঠিক হবেনা বলে মনে করছি...। ভিন্ন রাস্তা....?
ভালো থাকুন।
মহান আল্লাহ আপনাকে ও আপনার পরিবারকে সুস্থতা ও কল্যাণের মধ্যে রাখুন সব সময়!
আমিন ছুম্মা আমিন!
আমি কিছুদিন বিস্রামে আছি। পরিবার, সমাজ, কর্মক্ষেত্র, রাষ্ট্র এ সব কিছুর প্রতি কেমন এক অনীহা এসে গেছে। এটি এক ধরণের অবসাদ্গ্রস্ততা, আমার কিছু অনুভূতির সমস্যা রয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছে এটি এক ধরণের পাগলামি। কিন্তু আমি একজন অতি-সাধারণ মানুষ। তাই আমার সব কিছুই অন্যদের থেকে আলাদা। নিজেকে এক ধরণের পুনর্গঠন করছি বলতে পারেন।
ইনশা আল্লাহ ১লা মে থেকে নতুনভাবে নিজেকে পেতে পারি কিনা চেষ্টা করবো।
ভালো থাকুন।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন